আমি যে জায়গায় থাকি সেটাকে বলা হয় খাগড়াছড়ির কোনা। মানে ওই এলাকার পর বাংলাদেশের সীমানা আর নাই, চারপাশে ভারত, আমাদের বাড়ি থেকে ভারতের মানুষ ওদের গাড়ি চলাচল সবই দেখা যায়। এমন এলাকা থেকে একজন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসাটা কতটা যুদ্ধের সেটা অন্য কেউ অনুভব করতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি যে স্কুলে পড়াশুনা করেছি সেটা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। সেই ১৯৮৬ সাল থেকে আমিই প্রথম মেয়ে যে কিনা প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়ে এসেছি। দেখাদেখি পরের বছর আরো একজন মেয়ে পরিক্ষা দেয় এবং ভর্তির সুযোগও পায়। আমার এই জায়গায় আসার বড় অবদান ছিল আমার ভাইদের। আমার ভাই এবং কাজিনরা ৪ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে, তারা যখন বাড়িতে যেত তখন তাদের মেয়ে বান্ধবীদের ছবি আম্মুকে দেখাতো। সেই থেকে আম্মুর ইচ্ছা জাগে আমার মেয়েকেও ভার্সিটি পড়াবো। আম্মু অনেক মানুষের কথা সহ্য করেছে আমাকে পড়ানোর জন্য। আম্মুর ইচ্ছা পুরণ করেছি, আম্মুও আমাকে ভর্তি করিয়ে হুট করে চলে গেল। আমি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়ে গেলাম। বড় ভাইও ভার্সিটি থেকে বের হতে পারলো না। শুধু আম্মুই বের হয়ে গেল।
উত্যক্ত করা
অনেকে বলে ইভটিজিং অনেক কমে গেছে। এই কথাটা একে বারেই মিথ্যা মনে হয় আমার কাছে। আজও আমি ইভটিজিং এ শিকার হয়েছি। যারা এই হয়রানির শিকার হয় তারা জানে। হ্যা এটা শুধু ছেলেরা করে না, মেয়েরাও করে। এই উত্যক্ত করার প্রবণতা মুটেও কমেনি। আমি কুমিল্লা শালবন বিহারে একটা ছাত্র পড়াই। সেই সুবাদে আমাকে এই বিহারের মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই আমার বিভিন্ন বাজে কথা হজম করতে হয়। কাউকে কিছু বলিনা, ভয় করে যদি কিছু বললে আমাকে আরো খারাপ কথা শুনিয়ে দেয়! অনেকে বলে প্রতিবাদ করবি, কিন্তু কাজটা এতটা সহজ না আমার জন্য। টিউশনির সূত্রে আমি একাই যাই, ওখানে দলে দলে ছেলেরা ঘুরতে আসে, তারা ভাবে মেয়েটাও মনে হয় ঘুরতে আসছে একটু মজা নেই। এই মজা নেয়াটা কতটা বিব্রতকর তারা তা জানে না। সবকিছু হজম করে নেই। যখন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাই তখন তাদের সতর্ক করি, কাউকে যাতে টিজ না করে। কারন আমি জানি কতটা খারাপ লাগে। মেয়েরাও ছেলেদের উত্যক্ত করে, ওই দিন হলের এক নেত্রি আমাকে এসে বলতেছে, আজকে তোর এট স্যারকে টিজ করে আসছি, বলেই হা হা করে হাসতেছে। আমি ওই মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছি, আর মনে হল আমাকে যারা টিজ করছিল তাদের হিংস্র চেহারাগুলো ওই মেয়ের মুখে যেন ভাসছে।
একাকিত্বের ফসল
ওই দিন রাতে ভাইয়া ফোন দিয়েই কান্না শুরু করে দিছে, ভাবলাম আম্মুর কথা হয়তো মনে পড়েছে। জিজ্ঞেস করলাম কি হইছে ভাইয়া? বললো মোজাম্মেল নাকি কিছু খায় না, ঘুমায় না, কারো সাথে কথা বলে না, কেউ কোন প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না এমনকি আব্বুর সাথেও কথা বলে না। শুনে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আম্মু চলে যাওয়ার পর খারাপ কিছু শুনতে পারিনা। কি এমন হলো যে, সে এমন করতেছে। ফোন দিলাম ফোনটাও ধরে না, কারো ফোন ধরে না। আব্বুর ফোন দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম, প্রত্যেকটা প্রশ্নের জবাব হুম, না এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাথে সাথে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম, ক্লাস জাহান্নামে যাক আমি আগে বাড়িতে যাই। সকাল ৭ টা বাজে রওয়ানা দিয়ে বিকাল ৩.৩০ এর দিকে বাড়িতে পৌছালাম। ঘরে গিয়ে দেখি ও কাথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে। টেনে তুলে দেখি ওর চোখের নিচ গুলো কালো হয়ে গেছে, একেবারে শুকিয়ে গেছে, দেখেই আবারো ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। রাতে ভাইয়া এসে পৌছালো, তারপর সে আমাদের হাতে একটা চিঠি দিল। চিঠিটার ভিতরে ছিল ডিপ্রেশন। একা একা থাকতে থাকতে এই অবস্হা। ওরা নাকি কোন কিছু ভালো লাগে না, শুধু বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করতে ভালো লাগে। কারো কথাও ভালো লাগেনা, বিরক্ত লাগে সব। অনেক বুঝিয়ে, ডিপ্রেশন কাটানো কিছু নাটক, মুভি দেখিয়ে স্বাভাবিক করেছি, যদি প্রকাশ না করতো তাহলে কি হত কে জানে। আম্মু যাওয়ার পর ক্লাসে নাকি একা একা বসে থাকতো, হোস্টেলের রুমমেট গুলোও করনার কারনে বাড়ি চলে গিয়েছিল, সেখানেও একা, বাড়িতে আসার পর ঘরেও একা।
আব্বুর আকুতি, কবে আসবি?
আব্বু ফোন দিয়েই বলবে কখন আসবি? বলবে এটাই স্বাভাবিক, একলা একটা ঘরে কারোই ভালো লাগবে না। কোন মানুষ নেই, কেউ নাই একা একজন মানুষ। যে ঘরটা সবকিছুর শেষে একটু প্রশান্তির জায়গা ছিল, পরিস্হিতি সেটাকে এখন সব চেয়ে অশান্তির বানিয়ে দিয়েছে। যদি তিন ভাই বোনের একজনও বাড়িতে থাকতে পারতাম, তাহলে হয়তো আব্বুর এতটা খারাপ লাগতো না। একা একা রান্না করে খায় , অসহ্য হয়ে গেলে ফোন দেয় কবে আসবি? ভাইয়াকে ফোন দেয়, আর ছোট ভাই মোজাম্মেলকে সরাসরি হুকুম দেয়, তুই আয় আর কেউ আসা লাগবে না। ক্লাস মিস দিয়ে হলেও ও যায় ১,২ দিন থেকে আসে। আব্বুর কাছে হয়ত প্রত্যেকটা সেকেন্ড এখন বিভীষিকার মত। আমরাতো ভালোই আছি ক্লাস, পরিক্ষা, বন্ধু বান্ধব নিয়ে আছি, সময় চলে যাচ্ছে। কিন্তু ওই মানুষটা একা, একেবারেই একা, কেউ নাই। ফোন দিলে বলি আব্বু আমার তো পরিক্ষা, ক্লাস চলে, এই মিড, ওই মিড। কি করব একটা দিনের জন্যও যেতে পারছিনা। বাড়িটা দূরে হওয়ায় চাইলেও ২,১ দিনের জন্য যাওয়া যায় না। আজও ফোন দিয়েছে, আমি একা একা খেতে পারছি না, কবে আসবি? আমি ওই একই কথা বলে দিয়েছি, আব্বু আমার পরিক্ষা।
স্বপ্ন
আমার কিছু ইচ্ছা, কিছু স্বপ্ন সব সময় আমাকে নাড়া দেয়। ইচ্ছাগুলো পুরণ করা অনেকের জন্য খুব বেশি কঠিন না, কিন্তু আমার জন্য কঠিনই মনে হয়। অনেক টাকা পয়সা, ভালো খাওয়া, অনেক শপিং করা এগুলো কোন দিনও আমাকে টানে না। আমার একটা ইচ্ছা আমি বাংলাদেশের সবগুলো গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখবো। অনেকে হাসে, বলে মানুষ দেশের বাইরে ঘুরার স্বপ্ন দেখে, আর তুই বাংলাদেশ! কিন্তু আমার মনে হয় না এমন কেউ আছে, যে মৃত্যুর আগে নিজের দেশের প্রত্যকটা আনাচ কানাচ ঘুরে দেখেছে। আমার খুব ইচ্ছা স্বপ্নটা পূরন করার। জানি স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। আমার আরেকটা ইচ্ছা হলো কোন একটা পাহাড়ে একটা ঘর থাকবে, তার আশে পাশে সব ধরণের ফল বাগান থাকবে, অনেক ফুলের বাগান থাকবে, অনেক পশু পাখি থাকবে, একটা বড় পুকুর থাকবে, আর ওই ঘরটায় আমি থাকবো। ঘুম থেকে উঠেই যেন দেখি অনেক পাখি, অনেক ফুল ফুটে আছে , একটা শান্তি লাগা কাজ করবে। আরেকটা স্বপ্ন হলো কোন একটা সাগর পাড়ে একটা ছোট টং থাকবে। ওখানে আমার পুরো জিবন কাটিয়ে দিব, সারা দিন রাত ওই সাগরের কল কল ধ্বনি শুনে, তাকে দেখে কাটিয়ে দিব। সেখানে কোন হিংসা, মারামারি, হানাহানি কিছু থাকবে না।